ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বিশ্বকে হতবাক এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এক মানবিক সংকট তৈরি করেছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি ভ্লাদিমির পুতিনকে নিয়ে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রে।
কয়েক দশক ধরে রাশিয়ার শীর্ষ ব্যক্তিত্ব রয়েছেন তিনি, যার ওপর পশ্চিমারা সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রেখে আসছে। কিন্তু ইউক্রেনে তার যুদ্ধ শুরুর সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে একুশ শতকে এসে এ ধরনের যুদ্ধ বিশ্বের সব ঝানু কূটনীতিক এবং নীতি-নির্ধারকদেরও অবাক করে দিয়েছে।
পুতিন সবসময়ই তার ব্যক্তিত্ব এবং অতীতে রুশ দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির কর্মকর্তা হিসেবে বিশ্বকে কৌতুহলী করে তুলেছেন। মার্কিন সাময়িকী ফরচুনের তথ্য অনুযায়ী, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বার্ষিক প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার ডলার (বাংলাদেশি এক কোটি ২০ লাখ ৪২ হাজার টাকার বেশি) বেতন পান। এছাড়া তার প্রকাশ্যে ঘোষিত সম্পদের মধ্যে রয়েছে, ৮০০ বর্গফুটের একটি অ্যাপার্টমেন্ট, একটি ট্রেইলার এবং তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি।
কিন্তু তাকে প্রায়ই বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি বলে মনে করা হয়। বিনিয়োগ এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি হারমিটেইজ ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট ২০১৭ সালে পুতিনের ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যক্তিগত সম্পদ রয়েছে বলে দাবি করে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের বিচার বিভাগীয় কমিটিতে শুনানির সময় এই দাবি করেন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিল ব্রাউডার।
পুতিন এবং রাশিয়া সম্পর্কে তার ওই দাবি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়। কারণ ১৯৯০ এর দশকে রাশিয়ায় বড় ধরনের বিনিয়োগ ছিল ব্রাউডারের। তবে রুশ প্রেসিডেন্টের সম্পদের ব্যাপারে ব্রাউডারের এই দাবি পুতিনের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার সঙ্গে বেমানান হওয়ায় অনেক হাস্যরস করেন।
ফরচুন বলছে, পুতিন বিশ্বের বিভিন্ন নামীদামী কোম্পানির বিলাসবহুল ঘড়ি ব্যবহার করেন। প্যাটেক ফিলিপ্পির একটি পারপেচুয়াল ক্যালেন্ডার ঘড়ির মূল্য প্রায় ৬০ হাজার মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি প্রায় ৫১ লাখ ৬০ হাজার ৯২৫ টাকা)। এছাড়া ল্যাঙ্গে ও সোহনে টুবোগ্রাফের একটি ঘড়ির দাম প্রায় ৫ লাখ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি ৪ কোটি ৩০ লাখ ৭ হাজার ৭১০ টাকা)। উভয় ঘড়িই ব্যবহার করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
এখন থেকে ১০ বছর আগে রাশিয়ার বিরোধী গোষ্ঠী সোলিডারিটির প্রকাশিত একটি ভিডিওর ভিত্তিতে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, পুতিনের সংগ্রহে ৭ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের বিলাসবহুল ঘড়িও আছে; যা তার বার্ষিক বেতনের ছয় গুণ বেশি।
এছাড়া পুতিন কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী ১ লাখ ৯০ হাজার বর্গফুটের একটি বিলাসবহুল ম্যানসনের মালিক বলে মনে করা হয়। যার ছাদে বসে দেখা যায় কৃষ্ণ সাগর। তার সম্পদের মধ্যে আরও রয়েছে, ফ্রেসকোড সিলিং, গ্রিক দেবতাদের মূর্তিসম্বলিত মার্বেল পাথরের তৈরি সুইমিং পুল, স্পা, একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার, একটি অত্যাধুনিক আইস হকি রিংক, ভেগাস-ধাঁচের ক্যাসিনো এবং নাইটক্লাব। তার ম্যানসনে রয়েছে শত শত ডলার মূল্যের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ওয়াইন এবং স্পিরিট।
অতীতে রাশিয়ার বিরোধী নেতারা পুতিনের বিলাসবহুল ম্যানসনের ছবি প্রকাশ করেন। যারা এই ম্যানসনকে ‘পুতিনের কান্ট্রি কটেজ’ বলে অভিহিত করেন। ছবি প্রকাশের পর দাবি করা হয়, পুতিনের বিলাসবহুল বাসভবনের ডাইনিং রুমে রয়েছে ৫ লাখ ডলার মূল্যের আসবাবপত্র, ৫৪ হাজার ডলারের বার টেবিল, ৮৫০ ডলার মূল্যের ইতালীয় ব্রাশসহ সাজানো বাথরুম।
তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার ওলিগার্চ আরকাডি রটেনবার্গ বলেন, তিনিই ওই ম্যানসনের মালিক, পুতিন নন।
কৃষ্ণ সাগরের তীরঘেঁষা ওই ম্যানসন ছাড়াও ৬৯ বছর বয়সী রুশ এই প্রেসিডেন্ট আরও ১৯টি বিলাসবহুল বাড়ি, ৭০০টি গাড়ি, ৫৮টি বিমান এবং হেলিকপ্টারের মালিক বলে গুঞ্জন রয়েছে। তিনি যেসব বিমান ব্যবহার করেন, তার একটি ‘দ্য ফ্লাইং ক্রেমলিন।’ এই বিমান তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ৭১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; যেখানে রয়েছে স্বর্ণের তৈরি একটি টয়লেট।
মঙ্গলবার ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান ইতালিতে থাকা ১৪০ মিটার দীর্ঘ, ছয়-তলা বিশিষ্ট একটি বিলাসবহুল ইয়টের ছবি প্রকাশ করেছে। এই ইয়টের মালিকও পুতিন বলে ধারণা করা হচ্ছে। শেহেরাজাদে নামের এই ইয়টের মূল্য প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার। ইতালির তুসকান উপকূলের মেরিনা ডি ক্যারারা শহরের বন্দরে এটি নোঙ্গর করে রাখা হয়েছে।
গার্ডিয়ান বলছে, এই ইয়টে একটি স্পা, সুইমিং পুল, দু’টি হেলিপ্যাড, কাঠ পোড়ানোর অগ্নিকুণ্ড এবং একটি পুল টেবিল রয়েছে। মঙ্গলবার ইতালির সংসদে দেওয়া ভাষণে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি পুতিনের ওই ইয়ট জব্দ করতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রচুর সম্পদ থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমারা পুতিনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর কয়েক দিনের মধ্যে পশ্চিমা দেশগুলো পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্রসহ রাশিয়ার অভিজাত ব্যবসায়ীদের সম্পদ জব্দ এবং তাদের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এর বাইরে রয়ে গেছেন।
নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, পুতিনকে নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়েছে জার্মানির মতো ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের পীড়াপীড়ির কারণে। যারা রাশিয়ার শীর্ষ এই নেতার সাথে যোগাযোগের সব চ্যানেল খোলা রাখতে চান।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভের বরাত দিয়ে গত জানুয়ারিতে বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানায়, পুতিনের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে তা হবে রাজনৈতিকভাবে ধ্বংসাত্মক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার সামিল।